টাকা

খুব বেশি দিন হয়নি এই এলাকায় আসার। বলা চলে একদম নতুন। ছোট-খাট একটা সরকারী চাকুরী করি। মামা-চাচার জোর নেই বলে চাকুরীতে আজও প্রমোশন হয়নি। কিন্তু বদলী হচ্ছি ঠিকই। রাজনৈতিক লেজুড় বৃত্তির সাথে তাল মিলিয়ে লেজ দোলাতে না পারায় বেশিদিন এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারিনি। কর্ম জীবনে এই নিয়ে সাতবার বদলী হলাম। একজন তরুণ সরকারী কর্মকর্তার জন্য নিঃসন্দেহে এটা অনেক কষ্টের। সে যাই হোক নতুন জায়গায় এসেছি। এখনও অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারি নাই। এলাকাটির নাম আনন্দপুর। সুন্দর একটি নাম হওয়ার পরেও লোকজনের মূখে তেমন আনন্দের দেখা মেলে না। সরকারী কোয়ার্টারে উঠেছি। সরকারী কোয়ার্টারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এখানে গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবতে হয় না। রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা এসব সুবিধা ভোগ করা যায়। কিন্তু যাদের টাকায় আর পরিশ্রমে আমরা এসব সুবিধা ভোগ করছি, তারা এসব সুযোগ-সুবিধা পায় কিনা তা আমাদের মতো কর্মচারীরা হয়তো একবারও ভাবে না।
কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে সদর রাস্তায় যেতে সময় লাগে বড়জোর তিন থেকে চার মিনিট। এখানে আসার পর থেকেই দেখছি রাস্তার বাঁ পাশ ঘেষে একজন মাঝবয়সী লোক ভিক্ষে করছে। পা দুটো খুব সরু বলে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। প্রতিটা পথচারীকে সে বেশ সমীহ করে। হাত উঁচিয়ে সুন্দর করে সালাম জানায়। আর করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কয়েকটি টাকার জন্য হাতটি সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তার সালামের জবাব দিয়েছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম দেখেছি। সালামের জবাব দিলে পরে আবার ভিক্ষে দিতে হয় এই ভয়েই হয়তো বা কেউ তার সালামের জবাব দিতে চায় না। কিংবা ভিক্ষুক বলে হয়তো কারও কানে সালাম পৌঁছে না। প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে দেখা হয়। সারা মুখজুড়ে আধা-পাকা দাঁড়ি। উসকো খুসকো চুল। 
একদিন তার সাথে সামান্য আলাপও হয়েছিল। তখনই জেনেছি তার নাম ল্যাংড়া মজিদ। বাপ-মায়ের দেয়া নাম নয়। কারণ বাপ-মা থাকলে হয়তো আরও সুন্দর একটা নাম হতো তার। তখন হয়তো নাম হতো আব্দুল মজিদ কিংবা মজিদ-উল-ইসলাম। বাপ-মা কোথায় থাকে সেটা আজ অবধি জানতে পারেনি সে। জন্মের পরই পঙ্গু ছেলে ভেবে হয়তো ফেলে দিয়েছিল। তারপর তার বর্তমান সহৃদয়বান! ফুফু তাকে মানুষ করেছে। এমনটিই ভাবে মজিদ। সে বড় হয়েছে তার ফুফুর বাসায়। মহিলাটি তার কেমন ফুফু সে আজও জানে না। সারাদিন ভিক্ষে করে যতো টাকা আয় হয় তার সবগুলোই দিন শেষে তুলে দিতে হয় ফুফুর কাছে। যেদিন কম টাকা ভিক্ষা করে আয় হয় কিংবা কোন টাকা দিতে পারে না সেদিন কোন খাবার তার পেটের ভিতর যায় না। সে শুনেছে মেয়েরা নাকি একটু দরদী মনের হয়। কিন্তু তার ফুফু দেখে মনে হয় সব মেয়েরাই এক একটা রাক্ষসী। ক্ষুধার জন্য তারা সবকিছু করতে পারে। তাই ফুফুর কথা ভাবতে গেলেই সে একটু অবাক হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মজিদ বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তাকেও গালি দেয়। এটাকে ঠিক গালি বলা চলে না । বলা যায় কিছুটা অভিমানের সুর ঝরে পড়ে মুখ থেকে। আবার পরক্ষনেই তওবাও পড়ে নেয়। তবে বাবা-মায়ের কথা মনে হলে সে ঘৃনায় মুখটা আর এক পাশে সরিয়ে নেয়। ঠিক যেমন করে দুঃস্বপ্ন দেখলে মানুষ পাশ ফিরে শোয়। থুথু নিক্ষেপ করে মাটিতে। প্রতিদিন এভাবেই সে প্রতিশোধ নেয়।
সে দিন ছিল বৃহস্পতিবার। অফিসে কিছু জরুরী কাজ থাকায় তাড়াতাড়ি রওয়ানা হলাম। বাসার গলি ছেড়ে রাস্তায় উঠে দেখি এতো সকালেও একজন নতুন ভিখারীনি বসে আছে থালা নিয়ে। ঠিক যে জায়গায় মজিদ বসে ভিক্ষা করতো। মহিলার বয়স প্রায় সত্তুর এর কাছাকাছি। মুখে দাদ না থাকলেও বুঝা যায় একসময় সে প্রচুর পান খেত। কিন্তু এখন হয়তো টাকার অভাবে খেতে পারেন না বলে কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগছে। অফিসে তাড়া ছিল তাই তার সঙ্গে কথা বলতে পারলাম না। যদিও অতি পরিচিত ভিক্ষুক মজিদ কে না দেখে একটু টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু অফিসে গিয়ে কাজের চাপে বিষয়টি বেমালুম ভুলে গেলাম। অফিস থেকে বের হলাম যখন তখন প্রায় ছটা বেড়ে গেছে। কিন্তু বড়দিন বলে তেমন কিছু মনে হল না।
বাসার কাছাকাছি আসতেই সাড়ে ছটার মতো বাজল। সদর রাস্তা ছেড়ে বাসার গলির রাস্তায় ঢুকবো এমন সময় সেই বুড়ি ভিক্ষুকটির চিৎকার কানে এলো।
-ও ভাই, কে আছেন আমার ট্যাহা সব নিয়ে গেল। ধরেন, ধরেন।’ খেয়াল করলাম পথচারীরা কেউ শুনছে না। তারা যেন আজকাল অভ্যস্থ হয়ে গেছে এসব ব্যাপারে। কিন্তু আমি স্থির থাকতে পারলাম না। পিছনে ঘুরে দেখি মজিদ বুড়ির ভিক্ষার থালাটি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। এমন সরু পা দুটি নিয়ে সে কি অদ্ভূত ভাবে দৌড়াচ্ছে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। অথচ গতকালই তাকে দেখেছি চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে ব্যাঙের মতো বসে ভিক্ষে করছে। কিন্তু আজ সে দৌড়াচ্ছে। এটা কি তার মনের জোরে নাকি বুড়ির টাকার জোরে ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি দৌড়ে তাকে ধরে বুড়িটির কাছে নিয়ে আসলাম। মজিদ কে নিয়ে আসা মাত্রই বুড়িটি এক রকম প্রায় ছোঁ মেরে ভিক্ষার থালাটি নিজের আয়ত্বে নিয়ে নিল। এদিকে ধরা পড়ে যাওয়া মজিদ কাঁপছে। তারপরেও কাঁপা কাঁপা গলায় সে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় এমন, ‘এই বুড়ির জন্য আমি আজকে ভিক্ষে করতে পারি নাই। বয়স বেশি বলে সবাই শুধু তাকেই ভিক্ষে দিয়েছে। কিন্তু আমার দিকে কেউ চোখ তুলেও চায়নি। অথচ ফুফু আজ বলে দিয়েছে অন্যদিনের চেয়ে বেশি টাকা জোগাড় করে নিয়ে যেতে না পারি তবে সে বাড়ির পথ চিরতরে আমার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আর এজন্যই বুড়ির টাকার থালা নিয়ে আমি দৌড় দিছি। আপনিই বলেন এছাড়া আমি আর কি করতে পারি।
আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না। আস্তে করে মজিদের হাতটি ছেড়ে দিলাম। বুড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সে খুশি মনে টাকার থালাটি শক্ত হাতে ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। বাটিতে রাখা খুচরো টাকাগুলো আমাকে দেখে যেন ক্রুরহাসি হাসছে। তাদের দুজন কে ঐ অবস্থায় রেখে আমি পা বাড়ালাম বাসার দিকে। কিছুদূর গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি মজিদ উদাস নয়নে তাকিয়ে আছে পশ্চিম আকাশের দিকে। সন্ধ্যার অন্ধকার গ্রাস করছে বলে তার মুখের অভিব্যক্তিটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না তখন।

0 মন্তব্যসমূহ