চাকুরী দেয়ার নামে প্রতারণা

১১ মার্চ, রোববার, অফিসে বসে আছি। এমন সময় এক পরিচিতজনের ফোন। একটা ভাইভার জন্য কল পেয়েছে। আজকেই ভাইভা হবে এবং তারা নিয়োগও দিয়ে দিবে। স্থান চিনে না তাই বললাম তাই তাকে রিক্সা নিয়ে মৌচাক মোড়ে আসতে বললাম। বসকে বলে অফিস থেকে বের হয়ে মৌচাক মোড় গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে। রিক্সায় উঠতে উঠতে সে বলল, আজকেই জয়েন করতে বলেছে। দুই কপি ছবি ও কিছু টাকা নিয়ে আসতে বলেছে ব্যাংক এ্যাকাউন্ড করে দিবে বলে। অফিস থেকে নাকি শুধু দুইজন সিলেক্ট করা হয়েছে এর মধ্যে একজন যশোরের। চাকরী দেবে কিন্তু টাকা লাগবে কেন? যদি তারা কোন টাকা-পয়সা চায় তবে তুমি ভুল করেও দিবে না। বিকাল তিনটার মধ্যে আসতে বললেও আমরা অফিসে আসলাম দুইটার দিকে।
অফিসের ঠিকানা আগেই জানা ছিল এবং কাছাকাছি হওয়ায় খুব একটা বেগ পেতে হলো না। মগবাজার, ওয়্যারলেসগেট, ১৩৬ নূর জাহান টাওয়ারের ৫ম তলায় অফিস টি। লিফট বন্ধ নাকি নষ্ট ঠিক বুঝতে না পারায় সিঁড়ি ভেঙ্গেই পাঁচ তলায় গেলাম। ‘ফ্যাশন গ্রুপ লিমিটেড’ অফিসের নাম। ভিতরে ঢুকতেই দেখি খুব সুন্দরি, স্মার্ট একটি মেয়ে ও একটি ছেলে রিসিপশনে বসে আছে। সালাম দিলাম। বললাম ভাইভার জন্য কল করা হয়েছে। সিভি আগেই দেয়া ছিল। শুধু দুই কপি ছবি নিয়ে মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। একটু পর এসে বলল, যান ভাইভার ডাক পড়েছে।
বসে আছি অনেকক্ষণ হল। প্রায় আধঘন্টা পর সে বের হলে এসে বলল, ওরা টাকা চাচ্ছে। ব্যাংক এ্যাকাউন্ড এবং আইডি কার্ডের জন্য ৩,৫০০/- এবং প্রশিক্ষণের জন্য ৬,৫০০/- মোট ১০০০০/- টাকা। বুঝলাম বাটপারের খপ্পরে পড়ে গেছি। কিন্তু শেষ দেখা দেখবো বলে ওকে বললাম গিয়ে তুমি আবার যাও, গিয়ে বল এখন টাকা নেই। টাকা ছাড়া নিয়োগ দেয়া যাবে কিনা? ও আবার ভিতরে চলে গেল। এর ফাঁকে আমি অফিসটির চারদিকে চোখ রাখলাম। দেখি ছোট ছোট ৪-৫টি রুম। সন্দেহটি আরো ঘনীভূত হলো। ছোট একটি কথা বলতে গিয়ে ও আর বের হয়ে আসছে না। এক সময় তার ভাইভা শেষ হল। বাইরে বের হতে হতে বললাম, কি বলল তারা?
-আমার কাছে যে চারশত টাকা ছিল সেটা নিয়েছে এবং বলেছে আগামী কাল থেকে ট্রেনিং করতে। কথাটি শুনেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ওর হাত ধরে টেনে ভিতরে ঢুকলাম। সরাসরি ভাইভা রুমে। একজন মহিলা বসে আছে। বললাম, ম্যাডাম আপনি ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন কেন?
-ওর তো কোন অভিজ্ঞতা নেই, আর কোন পরীক্ষা নেওয়া ছাড়াই আমরা তাকে নিয়োগ দিয়েছি।
-কথা ছিল আপনারা ব্যাংক এ্যাকাউন্ড করে দিবেন। আপনার পরীক্ষা নিতে পারেন কিন্তু টাকা নিবেন কেন? টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিন।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ কথা চালাচালির পর তিনি বললেন, ঠিক আছে আপনারা বসেন। আমরা দুজনে আবার রিসিপশনে এসে বসলাম।
একটু পর দেখি রিসিপশনে বসে থাকা ছেলেটি একটি ফর্ম নিয়ে অন্য রূমে চলে গেল। এর মধ্যে আমার একটি জরুরী ফোন আসায় কথা বলতে ছিলাম। কথা শেষ করেই দেখি ও নেই। বললাম, আমার লোক কই গেল? ছেলেটি বলল, পাশের রূমে পরীক্ষা দিচ্ছে। পাশের রুমে গিয়ে উঁকি মেরে দেখি ছোট্ট একটি রুমে বসে সে একাই পরীক্ষা দিচ্ছে। বুঝলাম এটা তাদের নুতন একটি চাল। বের হওয়ার সময় আর একটি রুমে উঁকি মেরে দেখি মাঝ বয়সী একটি লোক শুধু টেবিল-চেয়ার নিয়ে বসে আছে। তাকে বললাম-ভাই আপনারা আসলে কিসের বিজনেস করেন (কেননা তাদের ওয়েব সাইটে যা দেখেছি এখানে এসে দেখি তার সম্পূর্ন বিপরীত)। চাকুরী দিচ্ছেন কিন্তু টাকা নিচ্ছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, এসব রিসিপশনে জিজ্ঞেস করেন? বলেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন।
পরীক্ষা শেষ। খাতাটি হাতে নিয়ে ছেলেটি এবার অন্য আর একটি রুমে চলে গেলেন। একটু পর সেখান থেকে ডাক আসলো। পরীক্ষার্থীনির সাথে আমিও সেই রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দেখি শুধু মাত্র একটি কম্পিউটার। তাও আবার মান্ধাতার আমলের সিআরটি সাদা রংয়ের মনিটর। কিছুক্ষণ পর লোকটি মুখ তুলে বলল, আপনি তো পরীক্ষায় ফেল করেছেন। আমি বললাম, চাকরীই যেখানে করবে না সেখানে আবার পাশ-ফেলের প্রশ্ন কেন? আপনারা যে টাকাগুলো নিয়েছেন ভালোয় ভালোয় সেগুলো ফেরত দিয়ে দিন। কথায় বলে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ তাই স্বভাবতই তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে উপতপ্ত বাক্য বিনিময় হল। শেষে তিনি বললেন, যান আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আর কোন টাকা-পয়সা দিতে হবে না। আপনি আগামী কাল থেকেই ট্রেনিং করেন। আমি বললাম ট্রেনিং কোথায় হবে? তিনি বললেন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে। আপনারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেন ‘কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ’ পদের জন্য আবার বলছেন ট্রেনিং হবে ফ্যাক্টরীতে ঠিক বুঝলাম না।
‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ বলেও একটি প্রবাদ আছে। শেষে তিনি বললেন, ঠিক আছে আপনার টাকা ১৪ তারিখে এসে নিয়ে যাবেন। আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, আজকে এবং এক্ষুনি টাকাগুলো দিয়ে দিবেন। বলেই আমার পরিচিত একটা বড় ভাইয়ের কথা বললাম। শুনে তিনি দমে গেলেন এবং সুর সুর করে টাকা বের করে দিলেন। অফিস ছোট হলেও চাকচিক্য দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এরা এতো বড় বাটপার। লক্ষ লক্ষ বেকার কে প্রতারণায় ফেলে এভাবে তারা হাজার হাজার টাকা কামিয়ে নিচ্ছে।
বিঃদ্রঃ চাকুরীর এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছিল দেশের অন্যতম চাকুরীদাতা ওয়েবসাইট ‘প্রথম আলোজবস্ ডট কম’ এ। এই সাইটে তাদের আরও চার-পাঁচটি পদের উল্লেখ ছিল।
Apply Instraction- এ লেখা ছিল
Managing Director
Fashion Group LTD
136, Nur Jahan Tower
Wrless, Moghbazar, Dhaka- এই ঠিকানায় ছবিসহ সিভি পাঠানোর জন্য।
আবার একদম নিচের দিকে Company Information-এ লিখা ছিল
Fashion Group LTD
Fashion Tower
98/B-A Bora Moghbazar, Dhaka.
web- www.fg-bd.com
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আকর্ষনীয় বেতনের উল্লেখ ছিল। এমন একটি প্রতারণামূলক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রথম আলোর মতো সেরা চাকুরীদাতা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যে কেউ আত্মবিশ্বাস নিয়ে Apply করতেই পারে। কিন্তু এমন প্রতারকের খপ্পরে পড়ে যদি কেউ তার সম্বল হারিয়ে ফেলে তার দায়-দায়িত্ব কি উক্ত জব সাইট এড়িয়ে যেতে পারে?

0 মন্তব্যসমূহ