কয়েকজন নিশাচর মানুষের গল্প

রাত বারটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। ঢাকা শহর। রাত আর দিনের তফাৎ এখানে ঠিক মতো বুঝা না গেলেও রাতের নিয়ন আলোয় এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয় এই শহরে। তারপরেও রাত বলেই হয়তো সবাই একটু ভয়ে থাকে, ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করে। আর রাতের এই ভয়টাকেই তারা কাজে লাগায়। তারা বলতে আয়নাল, মঞ্জু, ফারুর, জমিরসহ আরও বেশ কয়েক জন। রাতটা ঘুমের জন্য হলেও তারা কখনও রাতে ঘুমায় না। ঘুমায় তারা দিনে। এখানেই ব্যতিক্রম তারা। এজন্য হয়তো তাদের হৃদয়ে দয়া-মায়া একটু কমেই থাকে। মানুষের স্রোতমুখী এই ঢাকা শহরে এই মানুষগুলো এসেছে বিভিন্ন জেলা শহর থেকে ভাসতে ভাসতে। শুরুতে একজন আর একজন কে চিনত না। প্রয়োজনের তাগিদে তাদের মধ্যে পরিচয়ের সূত্রপাত।
ঢাকা শহরে কাজের খোঁজে এমনি ভাবেই ভাসতে ভাসতে একদিন এসেছিল রাজু। যুবক বয়স। বিয়ে করেছে এই ঢাকা শহরে এসেই। বস্তিতে থাকে। প্রথম যেদিন ঢাকা আসে সেদিন সে বসেছিল রমনা পার্ক-এ এক সন্ধ্যা বেলায়। সবে পার্ক-এ সন্ধ্যার সোনালী আলো ঢুকতে শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে তারই মতো এক যুবক উল্টো দিক থেকে দৌড়ে এসে তার পাশে বসে পড়ল। শুরুতে একটু চমকে যায় রাজু। ছেলেটির সন্ধানী চোখ ঠিকই রাজুকে চিনতে পারল যে, রাজু গ্রাম থেকে এসেছে এবং তার একটা কাজ চাই।
-কি নাম আপনার? প্রশ্ন করে যুবক।
-আমার নাম রাজু।
-আমি ফারুক, থাকি আগারগাঁও বস্তিতে। আপনি নিশ্চয় ঢাকায় নতুন এসেছেন। কাজ খুঁজছেন, কাজ করবেন নাকি আমার সাথে?
-কি কাজ? জানতে চায় রাজু।
-কাজ খুবই কঠিন। শুধু মানুষ ধরা। আর ডিউটি করতে হবে কিন্তু রাতের বেলায়।
এরকম একটি কাজের সন্ধান পেয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে না সে। আর সিদ্ধান্ত না নিয়েই বা সে কি করবে। ঢাকায় বউ, বাচ্চা নিয়ে এসেই সে হতাশায় ডুবে যায়। কাজ নেই। অনেক খুঁজেও সে কোন কাজ পায় নি। তাই সে রাজি হযে যায়। তারপর সেই ফারুকের হাত ধরেই এ পথে পা বাড়ায়। ধীরে ধীরে সবার সাথে পরিচয় হয় তার
আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছে রাজু। বউ-বাচ্চা নিয়ে সে সূখেই আছে। গ্রামের বাড়ী থেকে বুড়ো বাবা-মাকেও নিয়ে এসেছে। তাদের কে তুলে এনেছে বস্তি থেকে একটু অপেক্ষাকৃত ভালো জায়গায়। টাকা-পয়না হাতে এলেই যে মানুষের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসে রাজু এখন সেটা বুঝতে পারছে। তবে তার বউ তাকে এখন আর এ কাজ করতে দিতে চায় না। প্রায় প্রতি রাতেই নিষেধ করে। বলে ‘আমাদের তো এখন অনেক টাকা জমেছে, এই কাজ বাদ দিয়ে ফুটপাতে একটা ছোট দোকান দিয়ে ব্যবসা কর না’? কি দরকার এভাবে মানুষকে ঠকিয়ে, তাদের সর্বস্ব লুটকরার?
রাজুও তার বউকে কথা দিয়ে ফেলেছে। আসছে কুরবানির ঈদের আগেই সে আর একাজ করবে না। কিন্তু ঈদের দিনকয়েক আগেই ছিনতাই করতে গিয়ে রাজুসহ তার দলের প্রায়ই সকলেই পুলিশের হাতে আটক হয়। কিছুদিন জেলে থাকার পর জামিনে সবাই বেরিয়ে আসে। ততোদিনে পুলিশের রিমান্ডের নামে তাদের অত্যাচারে একেক জনের অবস্থা কাহিল। রাজু এ হাল দেখে জেল গেটেই কান্না শুরু করে দেয় তার বউ ও সন্তান। বাড়িতে এসে তওবা পড়ে বাবা-মা কে পাক্কা কথা দেয় রাজু। সে মরে গেলেও আর এ পথে পা বাড়াবে না।
ঈদের দিন ঘনিয়ে আসছে। আর দুদিন পরেই ঈদ। বেশ ফুরফুরে শান্ত মেজাজে ফুটপাতে একটা দোকান সাজাতে ব্যস্ত রাজু। প্রচুর গরমে শরীরের ঘেমে গেলেও বুকের ভিতর সে আজ একটা অন্যরকম আনন্দ অনুভব করে। সেই অনুভূতিটা তার বুকের ভিতরটাকে শীতল করে দেয় যেন। দোকান সাজাতেই বিকাল হয়ে আসে। সন্ধ্যার দিকে দোকান চালু করে রাজু। সে বিশ্বাসেই করতে পারে না যে ফুটপাতের দোকানে এমন বিক্রি হয়। এক সময় বেশকিছু টাকা জমা হয় তার বুকপকেটে। এই সৎ উপার্জনের টাকার গর্ব-এ তার বুকটা আজ ফুলে ওঠে। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে। কমতে থাকে মানুষের আনাগোনা। রাত বারটা বাজতে অর বেশি দেরি নেই। নতুন দোকান। তাই সে একটু দেরী করেই বন্ধ করে। দোকান বন্ধ করে সবে পা বাড়িয়েছে বাসার দিকে, তখন সে টের পায় চার-পাঁচটা ছায়া মূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ছায়া মূর্তির ভিতর থেকে কেউ একজন বলে ওঠে ‘ধর শালারে, শালার ভালো মানুষী শিখিয়ে দেব আজকে’।
কণ্ঠটা চিনতে খুব একটা দেরি হয় না রাজুর। এটা যে তারই একসময়ের সঙ্গি ফারুকের কণ্ঠ। কথাটা শেষ হতে না হতেই তার মাথায় কেউ একজন ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করে। সে বুঝতে পারে তার মাথা ফেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পিচঢালা পথে। এক হাতে মাথাটা চেপে ধরে আর একহাত দিয়ে বুক পকেটটা ধরে বসে পড়ে রাজু। এ টাকা যে তার সারা দিনের ঘাম ঝরানো টাকা। এ টাকাই যে এখন তাকে বেঁচে থাকতে সাহস দিবে।

0 মন্তব্যসমূহ