স্বপ্ন এবং বাস্তবতা

মানুষ স্বপ্ন দেখে। কেউ ঘুমিয়ে, কেউ জেগে থেকে। আবার কেউ বা তার সাজানো স্বপ্নগুলোকে বাস্তবেরূপ দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যায় দিবারাত্রি। অনেকেই আবার অলীক স্বপ্ন দেখতেও পছন্দ করেন, যে স্বপ্নটি সে জীবনেও বাস্তবায়ন করতে পারবে না। স্বপ্ন যেন এক ভাঙ্গা-গড়ার খেলা। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে মানুষ তার বুকে তীব্রকষ্ট অনুভব করে। কষ্টে অনেকেই নীল হয়ে যায়, একাকী কাঁদে, মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরেও মানুষ আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কারন স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায়, নতুন জীবন দান করে, প্রেরণা যোগায়, কাজে উদ্দমতা আনে। পৃথিবীর প্রতিটি সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের কিছু স্বপ্ন থাকে। যে স্বপ্নগুলো সঙ্গী করে সে তার ভবিষ্যৎ জীবন সাজাতে চায়, কর্মজীবন, বিয়ে, ছেলে-মেয়ে, সমাজ-সংসার প্রভৃতি বিষয়গুলো নিয়ে মানুষ তার স্বপ্নের বাগান সাজাতে শুরু করে। কখনও বা উড়ো কোন ঝড় এসে তার সেই সাজানো স্বপ্নের বাগানটি তছনছ করে দিয়ে যায়। ঝড় শেষে আবারও নতুন করে স্বপ্নের ডাল পালাগুলো গজাতে থাকে মনের গহীনে। বিচিত্র যেমন মানুষের মন স্বপ্নগুলোও তার তেমনি বিচিত্র।
একটি পরিবারে যখন কোন শিশু বড় হতে থাকে বাবা-মায়ের স্বপ্নগুলোও ঐ শিশুটিকে ঘিরে বাড়তে থাকে। প্রতিটি বাবা-মাই স্বপ্ন দেখে যে তার এই ছোট্ট সোনা মণিই হচ্ছে তাদের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সব বাবা-মায়ের চাওয়া থাকে তাদের ছেলে-মেয়েরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় চাকুরী করবে ব্যবসা করে দেশ ও দশের মুখে হাসি ফোটাবে। আর্তমানবতার সেবার পাশাপাশি তাদেরও একটু সেবা-শ্রশ্রূষা করবে। আবার ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। আমাদের এই ছোট গরীব দেশে অনেকেরই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। তাদের স্বপ্নগুলো হয়তো এতো বড় নয়, তারপরেও তাদেরও চাওয়া থাকে যে, তাদের ছেলে-মেয়েগুলোও শেষ বয়সে তাদের দিকে একটু চোখ তুলে তাকাবে। কিন্তু এই যান্ত্রিক ব্যস্ত শহরে ছেলে-মেয়েদের মন যেন অনেকটাই যন্ত্রের মত হয়ে গেছে। তাই দেখে যায় বাবা-মায়ের কষ্ট এখন আর তাদের কে তাড়া করে ফেরে না। যেখানে একা থাকাটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক বলে মনে হয় সেখানে বুড়ো বাপ-মাকে অনেকটাই উটকো ঝামেলা বলে মনে করেন তারা। আর ঠিক তখনই বাবা-মায়ের তার সেই ছোট্ট সোনামনি নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। যাদের একটু সর্মথ আছে হয়তো বা তাদের আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে আর যাদের সার্মথ নেই তাদের কে অন্যের দুয়ারে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। আর বাবা-মা তার বুক চেপে স্বপ্নগুলো কবর দেয় সেখানেই। মানবতা যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে তখন।কিন্তু আমরা আর এমন স্বপ্ন দেখতে চাই যেখানে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিতে হয় বাবা-মাকে, ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে ঘুরতে হয়। আমরা এমন পশ্চিমা সংষ্কৃতি চাই না যেখানে বাবা-মায়ের সাজানো স্বপ্নের কবর রচিত হয়।
আবার ফিরে আসি পরিবারের কথায়। শিশুটি বড় হয়ে থাকে, বড় হতে থাকে তার স্বপ্নগুলোও। স্বপ্ন নিয়ে হয়তো বা তার একটি নিজস্ব জগৎ তৈরী হয়। যেখানে সে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে সে হয়তো তার স্বপ্নের কোন চাকরী বা ব্যবসা জুটিয়ে নেয়। এবং মনের এক কোণে যেখানে সে তার জীবন সাথীর জন্য একটু জায়গা রেখে দিয়েছিল, সে জায়গাটুকু সে পূরণ করে নেয় স্বপ্নের বাসর সাজিয়ে। প্রেম-ভালবাসার পূর্ণতায় তার জীবন কানায় কানায় পরিপূর্ন হয়ে ওঠে। সুখের আতিশষ্যে তার চোখ দুটো হয়তো বুজেঁ আসে, গুন গুন করে গেয়ে ওঠে প্রিয় কবির কবিতার কয়েক পংক্তি কিংবা প্রিয় কোন গানের কয়েক লাইন। হোক না সেটা বেসুরো গলায়।
এর বিপরীত চিত্রও আমরা দেখি সমাজে। লেখাপড়া শেষ করে চাকরি না পেয়ে কিংবা কর্মক্ষম থাকার পরে কাজ না পেয়ে হতাশায় ডুবে মরছে শত শত বেকার যুবক। হয়তো বা তারা তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নগুলো কে আর লালন করতে পারছে না। হয়তো এবার স্বপ্নগুলো মৃত্যুই হবে, ভাবছে তারা। কারন চাকরি নেই, কাজ নেই তাই হয়তো সে এবার তার স্বপ্নের রানীকে হারাবে। যাকে নিয়ে সে কোন এক পূর্ণিমার আলোয় বসে মনের গহীনে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন সাজিয়েছিল।
কিন্তু মেয়ের বাবা-মাও তো মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। তারা স্বপ্ন দেখে তাদের হবু জামাই উচুঁ পদে চাকরি করবে কিংবা একজন নামী-দামি ব্যবসায়ী হবে, সমাজে তার নাম-ডাক থাকবে। একজন শ্রমজীবি বাবা-মাও স্বপ্ন দেখে যে তার মেয়েটির একটি ভালো ঘরে বিবাহ হোক। তাদের মতো কষ্ট যেন করতে হয় না ওকে। তার স্বপ্নের চাকরি না পেয়ে, উপযুক্ত কর্ম না পেয়ে সর্বপরি তার স্বপ্নের রানীকে না পেয়ে বেকার যুবকের স্বপ্নের প্রথম অধ্যায়ের মৃত্যু ঘটে। কিছু দিন পেরিয়ে গেলে কষ্টগুলোকে সে মাটিচাপা দিয়ে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে একটি নতুন চাকরি, সুন্দরী বউ, দখিনা বারান্দার একটি ঘর, ছোট্ট একটি সংসার……………।

আশায় থাকি মোরা
আশায় বাঁধি বুক,
স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন আঁকি
হোক না সে পথ বড়ই বন্ধুর।

0 মন্তব্যসমূহ