যে বৃষ্টি কোন আনন্দের সংবাদ দেয় না

ঘুমের ঘোরে নাক ডাকার শব্দ অসহ্য লাগে রুণার। ছোটবেলা থেকেই এব্যাপারে সে বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিল। আর তার কপালেই কি না এমন স্বামী মিললো পেল যে কিনা নাক ডাকা ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। অথচ স্বামীর এই ডাকা স্বভাবটি তার অসহ্য লাগলেও মাঝে মধ্যে যখন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে ঊঠে স্বামীর নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় না তখন মনের অজান্তেই চুপসে যায় রুণা। মনে করে স্বামীর কিছু হলো না তো আবার! ভয়ে ভয়ে স্বামীর বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়ে হৃস্পন্দন শুনতে চেষ্টা করে। আর যাই হোক মানুষটাকে আসলে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে। এমন সহজ-সরল মানুষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া সত্যিই বড়ই দায়। ছোট সংসার। দু’জন মানুষ। পৃথিবীতে আর একজন মানুষ আনার চেষ্টা করছে তারা। ঢাকা শহরের ছোট একটা টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে দুজন। সংসারে কোন অভাব নেই। বেশ স্বচ্ছন্দেই কাটছিল দিনগুলো।
বলছিলাম রফিকের কথা। রফিক! বয়স ত্রিশের মতো হবে। অল্প লেখাপড়া জানা মানুষ তবে বেশ সামর্থবান সুপুরুষ। দিনে আনে দিনে খায়। পেশা রিক্সা চালানো। সারাদিন রিক্সা চালিয়েও যখন সে রাতে ঘরে ফেরে তখনও সে বেশ সতেজ। ফুরেফুরে মেজাজে গান গাইতে গাইতে রুমের ভিতরে ঢুকেই ব্যাগের ভিতর থেকে ছোট্ট একটা পোটলা বের করে বৌয়ের হাতে তুলে দেয়। রুণাও একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে পোটলা খুলে ভিতর থেকে একটা সিংগাড়া বের করে মুখে দেয়। এই জিনিসটা তার খুবই প্রিয় বলে প্রতিদিনই রফিক ঘরে ফেরার সময় কিনে নিয়ে আসে। খাওয়া শেষে যখন তারা রাতে ঘুমাতে যায় তখন রাজ্যের গল্প এসে ভীড় করে দু’জনার মাথায়। যে মানুষটি আসতে চাচ্ছে তার জন্য কল্পনার বীজ বুনতে থাকে তারা। রফিকের ইচ্ছা তার প্রথম সন্তান মেয়ে হোক। যার নাম রাখবে সে পূর্বাশা। বেশ সুন্দর নাম। আর রুণার চাওয়া তার একটা ছেলে হোক। আবার তারা দু’জনেই মাঝে মাঝে বলে, ‘ছেলে হোক আর মেয়ে হোক কোন সমস্যা নাই’। তাকে লেখাপড়া করে মানুষ করাটাই বড় কথা।’
সত্যিই তো এমন দুর্দিনে ছেলে-মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করে তোলাটা খুব কষ্টের কাজ। যখন কিনা সন্তানের সামনে মাদক, অস্ত্র আর নানা অসামাজিক কাজের অপার হাতছানি। মাঝে মাঝেই তারা ভাবে, কেন তারা শহরে আসলো। গ্রামে থাকলেই মনে হয় ভাল হতো তাদের।
আর বেশিদিন নেই। রুণার পেট ধীরে ধীরে আগের চেয়ে আরও বড় হতে থাকে। শাড়ি আঁচল দিয়ে পেট ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে। সেটা দেখে রফিক হেসে হেসে একদিন বলে-‘আরে ঢেকে রাখ কেন? দেখতে দাও, দেখতে দাও। যে বাবুটি আসছে সে মোটা হবে না চিকন হবে আগে থেকেই দেখে নিই।’ প্রায়ই এমন করে লোকটি। আর একদিন রাতে রুণার পেটের মধ্যে কান পেতে দিয়ে রফিক বলে- ‘দেখছো, বাবুটি আমাকে বাবা, বাবা বলে কেমন করে ডাকছে? অথচ সে মা, মা বলে একবারও ডাকছে না। একেই বলে বাপকা বেটা।’ বলেই হো হো হো করে হাসতে থাকে । তার হাসি শব্দে এক অদ্ভুত ভাললাগা কাজ করে রুণার দেহ-মনে। এমন পাগলামী এখন রফিক প্রায়ই করে থাকে। এমনও হয়েছে যে কোনদিন হয়তো সে রিক্সা বেরই হয় না। রুণা বুঝতে পারে রফিক এখন আগের তুলনায় তাকে আরও বেশি ভালোবাসে। প্রায় রাতেই তারা স্বপ্নের জাল বুনতে থাকে। সে জাল বড় হতে হতে আকাশ ছুঁতে চায়। তারপরেও তাদের স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয় না।
এমন সুখের সংসারে একদিন রুণার জীবনে হঠাৎ করে ছন্দপতন ঘটে । সেদিন সন্ধ্যার পর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আকাশ কালো করে নামছিল বৃষ্টি। যে মানুষটা রাত আটটার মধ্যেই ঘরে ফেরে সে মানুষটা রাত দশটা পর্যন্ত ঘরে না ফেরায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে সে। রাত বারটার দিকে রিক্সা নিয়ে ভিজেই ঘরে ফেরে রফিক। আজ তার সেই ফুরফুরে মেজাজ নেই, মুখে গান নেই। আজ আর আদরের বউয়ের জন্য সে ব্যাগ থেকে কোন পোটলাও বের করে না। ঘরে ঢুকেই ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। রুণা দ্রুত কপালে হাত দিতে গিয়ে কটু গন্ধে পেয়ে সরে আসে। তার স্বামীর মুখ থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। বুঝতে পারে কেউ তাকে কিছু খাইয়েছে। কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আবারও বিছানায় পা মেলে বসে স্বামীর মাথাটি উরুর উপরে নিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রুণা। যে মানুষটি বিড়ি-সিগারেট তো দূরের কথা পান পর্যন্ত খায় না সে কিনা আজ মরণ নেশা করেছে।
বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর আস্তে আস্তে চোখ খুলে বিড়বিড় করতে থাকে রফিক। রুণা শুনতে পায় সে বলছে, ওরা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে বউ। আমারে জোর করে কি সব ছাইপাশ খাওয়া দিছে। তুমি আমাকে বাঁচাও। ওরা বলতে রফিকের বন্ধু যারা তার সাথেই ঘুরে, এক সঙ্গে রিক্সা চালায়। সেদিন বৃষ্টি হওয়ায় দেরী হচ্ছিল দেখে রফিক কে একপ্রকার জোর করে তারা সবাই একটা ছোট্ট ঘুপরি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে আরও কিছু লোকের দেখা মেলে। তার স্পষ্ট মনে আছে জব্বার তাকে একদিন এখানকার কথাই বলেছিল। কিন্তু সেই জব্বার একরাতে এখান থেকে গিয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পরের দিন সকালেই মারা যায়। জব্বারের কথা মনে হতেই সে ঘর থেকে বের হতে চাইলে তারা জোর করে তাকে বসিয়ে দেয়।
ঘোরের মাঝে সে কতক্ষণ ছিল বুঝতে পারে না। যখন বাইরে আসে দেখে রাস্তায় কেউ নেই। শুধু কয়েকটা দুরপাল্লায় বাস শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে চলে যাচ্ছে।
রুণা কাউকে যে ডাকতে যাবে তারও উপায় নেই। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি আর প্রচন্ড বাতাস বইছে। এদিকে পেটের ব্যথাও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে তার। উপায় না পেয়ে ঘরে ভিতর যতটুকু পানি ছিল সবগুলো পানিই স্বামীর মাথায় ঢালতে থাকে।
ভোর রাতের দিকে ধীরে ধীরে বৃষ্টির পরিমাণ কমতে থাকে আর এদিকে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হতে থাকে রফিকের দেহ। সকালে রুণার হাউমাউ কান্না শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে দেখে বিছানার ওপর শুয়ে আছে রফিক। পা দুটো তখনও তার নিচের দিকে ঝুলানো। আর ঘরের মাঝখানে পেটের তীব্র ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছে রুণা। একটু পরেই রুণার কান্নার সঙ্গে আর একটা সদ্যজাত বাচ্চার টোঁয়া টোঁয়া কান্নার আওয়াজ যোগ হয়। কিন্তু সে কান্নার আওয়াজ কানে যায় না রফিকের।
আকাশ এখনও তার গুমোট ভাবটি ধরে রেখেছে। যেকোন মূহুর্তে আবারও তুমুল বৃষ্টি এসে ধুয়ে নিয়ে যাবে শহরের সব আবর্জনা। কিন্তু পচে গিয়ে দূগর্ন্ধ বের হওয়া যেসব আবর্জনার কারণে রুণার জীবনের এই পরিণতি তারা কি চিরকালই এই বৃষ্টিতে ভিজে আরও তরতাজা হবে? বৃষ্টিকি তাদের ধুয়ে-মুছে নিয়ে এই শহরটাকে পবিত্র করবে না কোনদিন? এই প্রশ্নটিই ঘুরে ফিরে আসতে থাকে রুণার মনে।

0 মন্তব্যসমূহ