সালিশ

সেই সকাল সাতটা থেকে হাসু মাতবরের বাড়ির আঙিনার বেঞ্চিতে বসে আছে বড়বাড়ী গ্রামের দিনমজুর কৃষক জয়নাল। মাতবর গতকাল বিকেলে বলেছে আজকের মধ্যেই তার সমস্যার একটা বিহীত করে দেবে। আজ সাত দিন ধরে সে মাতবরের পিছে পিছে ঘুরছে। মাঝখানে একদিন থানাতেও গিয়েছিল। কিন্তু দারোগা টাকা ছাড়া মামলা নিতে রাজি হয়নি। এক-দুশ টাকা নয়, দশ হাজার টাকা চেয়ে বসেছে থানার দারোগা। কিন্তু কোথায় পাবে সে এতো টাকা! বাড়িতে জমানো যতটাকা ছিল সবগুলোই মেয়ের চিকিৎসার পেছনে ব্যয় হয়েছে। তারপরেও মেয়েটা এখনো ঠিক মতো উঠে দাঁড়াতে পারে না। চিকিৎসার জন্য আরও যে কত টাকা লাগবে আল্লাহ মালুম। জয়নাল ইতিমধ্যে শুনেছে যে মতিন ঠিকাদার থানায় কয়েক লাখ টাকা দিয়েছে, তাই দারোগা মামলা নিচ্ছে না। কে জানে হয়তো মাতবরকেও তারা টাকা দিয়েছে। তাদের অনেক টাকা। টাকা দিয়ে তারা অন্যায় কে ন্যায়ে পরিণত করতে পারে। বেঞ্চিতে বসে আকাশের দিকে মুখটা তুলে এসবই ভাবছিল জয়নাল। হঠাৎ মাতবর হাসুর ডাকে সম্বিত ফিরে পায় সে। মাথাটি একটু নিচু করতেই দেখে মাতবর দাঁড়িয়ে সামনে। সে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। হাসু মাতবরের বয়স প্রায় পঞ্চান্ন-এর কাছাকাছি। পান খাওয়ার কারনে অনেকগুলো দাঁতই কালো আবরণ পড়েছে। দাঁতগুলো দেখে কেন জানি জয়নালের মনে হয় মাতবরের হৃদয়েও হয়তো এমন একটি কালো স্তর পড়ে আছে। যেখানে এখন আর কোন বিবেক বাস করে না। কারণ তার বিবেক থাকলে তারই পাড়ায় এতোবড় একটা ঘটনা ঘটার পরেও তিনি নিশ্চুপ থাকতে পারতেন না।
-“শোন জয়নাল মিয়া, পাড়ার সবার সাথে কথা হয়েছে আজ বিকেলে তোমাদের বিষয়টা নিয়ে সবাই সালিশে বসবো” পান চিবোতে চিবোতে কথাগুলো বলেন মাতবর হাসু।
-“জী চাচা” মুখ কাচুমাচু করে জবাব দেয় জয়নাল।
-“মতিন ঠিকাদারের সাথেও কথা হয়েছে আমার, তার ছেলেও উপস্থিত থাকবে। আর একটা বিষয় সালিশের সময় তোমার মেয়েকেও উপস্থিত থাকতে হবে, বুঝছ”।
-জী
-“আচ্ছা, এখন যাও, তোমার পক্ষের লোকজন নিয়ে বিকেল বেলা এখানে আসবে”।
ধীর পায়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসে জয়নাল। জমির মাঝখানের মেঠোপথ ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে সে।
অন্যের জমিতে দিনমজুর খেটে সংসার চলে তার। নিজের জমি-জমা বলতে বাপের রেখে যাওয়া ঐ ভিটাবাড়ী টুকুই। সংসারে তারা চার জন মানুষ। স্বামী-স্ত্রী, ক্লাশ নাইনে পড়া মেয়ে লাইলী আর দুই বছর বয়সী ছোট বাবু হাসান। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে সে। কঠোর পরিশ্রমী জয়নাল আজ বড়ই ক্লান্ত ও বিমর্ষ। চার জনের ছোট সংসারটি বেশ সুখের ছিল। সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠে সে বেরিয়ে পড়তো কাজের খোঁজে। কাজ শেষ করে ঘর্মাক্ত শরীরে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে মেয়ের ফর্সা মায়াবী মুখের দিকে তাকাতো তখনই প্রাণটা জুড়িয়ে যেত তার। দিনের সমস্ত ক্লান্তি যেন দূরে চলে যেত। নিজেকে ভীষন ভাগ্যবান ভাবে জয়নাল। কয় জনের সংসারেই বা এমন একটা মেয়ে অর একটা ছেলে আছে। কিন্তু ভাগ্য বিধাতা একদিন তার ভাগ্যটিকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলল। এখন আর সে মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। বরং এখন মেয়ের মুখের দিকে তাকালে তারই সারা দেহে বিষাদের কালো ছায়ায় ঢেকে যায়।
গেল সপ্তাহে এক সুন্দর সকাল দেখে কাজে বের হয়েছিল জয়নাল। যাবার আগে লাইলী কে বলে যায় স্কুলে যাওয়ার জন্য। কাজ শেষ করে বিকালে বাড়ি ফিরে দেখে তখনও ফেরেনি লাইলী। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও মেয়ে ফিরে না আসায় বাড়ির বাইরে পা বাড়ায় জয়নাল। বড় রাস্তার মোড়ে আসা মাত্রই দুঃসংবাদটি কানে আসে তার। তার মেয়ে হাসপাতালে। সংবাদ শোনা মাত্রই উর্দ্ধশ্বাসে যেন দৌড়াতে থাকে।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে লাইলী। ফর্সা চেহারাটি ভয়ে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জয়নাল। এতবড় সর্বনাশ কে করল তার? মেয়েটি শুধু বলল, মতিন ঠিকাদারের ছেলে জামাল। কথা বলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে তার আদরের মেয়ে লাইলী।
বিকেল বেলা। মাতবর বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন লোকজনের বেশ আনাগোনা। আর কিছুক্ষণ পরেই সালিশ বসবে। সালিশে মাতবরসহ সবাই হাজির। কিন্তু মতিন ঠিকাদারের এখনও দেখা নাই। ইতিমধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়। অনেকেই বলতে থাকে ‘মেয়েটিকে আরও আগেই বিয়ে দেয়া উচিৎ ছিল জয়নালের। মেয়েকে এত লেখা পড়া শিখিয়ে কি হবে?’ আরও বেশ কিছু কটুবাক্য শুনতে হলো সেখানে লাইলী কে। যেন বিচার শুরু হওয়ার আগেই তাকে একদফা শাস্তি দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে একজন খবর নিয়ে আসল মতিন ঠিকাদার সালিশ মানেন না। তাই সে উপস্থিত হবে না। শুনেই সেখানে আর স্থির থাকতে পারল না মেয়েটি। দৌড় দিল নিজের বাড়ির দিকে। এর কিছুক্ষণ পরেই জয়নালের বাড়ি থেকে কান্নার রোল ওঠে। পৃথিবীতে আর বেঁচে নেই লাইলী।
একমাত্র আদরের মেয়েকে হারিয়ে হাহাকার করতে থাকে জয়নাল। তার এ হাহাকার সমাজপতিদের বুকে গিয়ে বিঁধে কিনা কে জানে। সে বিচারের দায়িত্ব ছেড়ে দেয় ওপর ওয়ালার কাছে। তার মতো গরীবের এছাড়া আর কিবা করার আছে।

0 মন্তব্যসমূহ