ময়না

মধ্যরাতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় সহিদ আলীর। পাশে তার বউ ময়না ঘুমিয়ে। জানালার ফুটো দিয়ে চাঁদের আলো মুখে পরায় চাঁদের মতই সুন্দর লাগছে তাকে। ময়না এমনিতেই সুন্দর। এ নিয়ে সহিদ আলী একটু গর্বই করে। খুব বেশি দিন হয়নি তাদের বিয়ের। ময়না কে বিয়ে করার পর মনে হয়েছে আরো আগে কেন সে তাকে বিয়ে করল না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দটা আরও বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে একটা না, এক সঙ্গে তিন-চারটি কুকুর ডাকছে। ঘেউ ঘেউ শব্দ তার কানে তীরের মতই বিঁধছে। গ্রামের মুরুব্বিরা বলে যে বাড়িতে মধ্যরাতে কুকুর,বিড়াল চিৎকার করে সেই বাড়িতে নাকি অমঙ্গল হয়। অমঙ্গলের চিন্তা মাথায় আসতেই একটু সতর্ক হয়ে ওঠে সে। দ্রুত কুকুরগুলোকে বাড়ীর বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে এসে দেখে ময়না ঘুম থেকে জাগছে।
-কই গেছিলা এতো রাতে? উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে ময়না।
-বাইরে, শুনোনি কুকুরগুলো কেমন করে ডাকছে। মাঝরাতে কুকুর ডাকলে নাকি অমঙ্গল হয় তাই তাড়িয়ে দিয়ে আসলাম।
কথাটা শুনেই হাসতে থাকে ময়না। সহিদ আলীর মনে হয় ময়নার হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে পড়ছে। সেই মুক্তো আর চাঁদের আলো মিশে যেন এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই নির্জন রাতে।
-তুমি শিক্ষিত মানুষ। এসবে তুমি বিশ্বাস কর?
-বিশ্বাস-অবিশ্বাস বলে তো কিছু না বউ। ভয়! বুকের মধ্যে সব সময় একটা ভয় কাজ করে।
-কিসের ভয়? একটু ভয় পেয়েই জিজ্ঞাসা করে ময়না।
-সেটা তুমি বুঝবা না বউ। বলেই ময়নাকে বুকের ওপর টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ে সহিদ আলী।
সহিদ আলীর সংসার বলতে তারা দু’জন। বাপ মারা গেছে সেই ছোট বেলায়। তার কথা এখন মনেই করতে পারে না সে। তার পর মা’ই তাকে মানুষ করেছে। খুব কষ্টে গেছে তখনকার দিনগুলো। খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে ডিগ্রীটা পাশ করেছে। এদিকে মায়ের বয়স বেড়ে যাওয়ায় তাকে বিয়েও করতে হয়েছে। বিয়ের তিন-চার মাসের মাথায় তার মা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে। তার পর থেকেই সংসার টা শক্ত হাতে আগলে রেখেছে ময়না। যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি সংসারি মেয়ে সে। এমন সুন্দর মেয়ের সন্ধান তার মা যে কোথা থেকে পেয়েছে এটা ভাবতে গেলেই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে তার।
পরের দিন খুব সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠে সহিদ। টুকিটাকি কাজ সেরে বাড়ীর দরজায় এসে উঁকি দেয় সে। দেখে ভেজা চুলে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ময়না।
-এমনি দেখে সাধ মিটে না,না! এখন আবার চুরি করে দেখা হচ্ছে।
-চুরি করে দেখার মজাই আলাদা বউ। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে সহিদ।
- হয়েছে আর সোহাগ করতে হবে না। গরু গুলোকে নিয়ে মাঠে যাও। সেখান থেকে ফিরে দুপুরে খাওয়া শেষ করে বিকালে আবার বাজারে যেতে হবে।
ময়না গতকাল সন্ধ্যায় বলেছিল তরি-তরকারি, মরিচ, পেয়াজ সব শেষ। সবকিছুই আনতে বাজার থেকে। বাজারটা অনেক দূরে হওয়ায় সপ্তাহের বাজার একদিনেই করে সহিদ। আজ সপ্তাহের শেষ দিন। বিকাল হতেই বাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকে সে। বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যায়। পিছে পিছে যায় ময়না। সহিদ জানে বাড়ীর সামনেই বড় রাস্তায় তাকে ‍উঠিয়ে দিয়ে তারপর ঘরে ফিরবে সে। বাইরে যাওয়ার সময় বরাবরই এমন করে মেয়েটি। আবার ফিরে আসার সময় দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে তারই প্রতিক্ষায়।
সন্ধ্যার একটু পরেই বেশ আনন্দেই বাজার নিয়ে বাড়ীর পথে রওনা হয় সহিদ। কই মাছ কিনেছে সে। ময়না কই মাছ খাবে বলে কয়েকদিন আগে বলেছিল। মাছ তার খুব পছন্দ। বাড়ীর সামনে আসতেই একটু ধাক্কা খায় সহিদ। একি!তার বাড়ীর সামনে এতো মানুষ কেন? ময়না আজ দরজায় দাড়িঁয়ে নেই কেন? উঠোনে আসা মাত্রই হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা পড়ে তার। কই মাছগুলো ব্যাগ থেকে বের হয়ে ছটফট করতে থাকে বাচাঁর জন্য।
কি হয়েছে ময়না। চিৎকার করে ওঠে সহিদ।
কিন্তু তার ময়না পাখি কথা বলার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। তারা সারা শরীরে হায়েনার আঁচড় লেগে আছে। ফর্সা টুকটুকে গালটি রক্তের মতো লাল হয়ে আছে। ময়না কথা বলা চেষ্টা করে। কই মাছ গুলোর মতোই বাঁচার জন্য ছটফট করতে থাকে সে। আর সহিদ তার ময়না পাখিকে বাঁচানোর জন্য সমস্ত শক্তি দিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করে।

0 মন্তব্যসমূহ