দুঃস্বপ্নের কালো রাত্রি

মাঝ রাত্রের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় আসিফের। একটি দুঃস্বপ্ন দেখেছে সে, ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। স্বপ্নটি দেখেই ঘুম থেকে চমকে ওঠে আসিফ। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় হাত ঘড়িটা একবার দেখে নেয়। রাত দুইটা। নীরব শান্ত পরিবেশ। থেকে থেকে কয়েকটা নিশাচর পাখির ডাক কানে আসছে। ঘুমে অচেতন সবাই, মনে হয় যেন ঘুমেরপুরী। কালো অন্ধকারে ঢেকে পড়েছে চারদিক। কেমন যেন ভূঁতুড়ে পরিবেশ। গা ছম ছম করে ওঠে আসিফের। আসিফ বুঝতে পারে সে আর ঘুমাতে পারবে না। তারপরেও বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করে। শেষ রাত্রের দিকে অনেক চেষ্টায় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙ্গে সকাল ন’টার দিকে তার মায়ের ডাকাডাকিতে। মা সায়রা বানু ছেলেকে দেখে চমকে উঠেন। তার চিরচেনা এই ছেলেটিকে আজকে চিনতে যেন কষ্ট হচ্ছে। মুখ কেমন কালো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মাত্র একরাত্রে মানুষ এত পাল্টে যেতে পারে…..ভাবতেই পারে না বৃদ্ধা মা।
-কি হয়েছে বাবা তোর? তোকে এত চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
মায়ের কথা যেন শুনতে পায়নি আসিফ। তার মা আবার জিজ্ঞাসা করে, আসিফ তো কি হয়েছে? এবার চমকে উঠে আসিফ। মনে পড়ে যায় রাতের সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের কথা। আসিফ জানে এই স্বপ্নের কথা তার মাকে বলা যাবে না। বললে হয়তো এখনই হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠবে। কোন কষ্ট দিতে চায় না সে তার মাকে। জন্মের পর থেকে বাবা কে দেখেনি। বাবার আদর কি জিনিস জানে না। মা তাকে বাবার অভাব কখনও বুঝতে দেয় নি। তাই আসিফ তার মাকে কষ্ট দিতে চায় না।
-কি হল বাবা, কিছু বলছিস না যে? আবার জিজ্ঞেস করেন তার মা।
আসিফ কোন রকমে বলে, কই কিছু হয়নি তো মা। কথাটা বলেই তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে যায় আসিফ, যদি পরে আরও কিছু জিজ্ঞেস করে… এই ভয়ে। বাড়ি থেকে কলেজে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়ে আসিফ। মোড় থেকে একটা রিকসা নিয়ে সোজা কলেজে যাবার নির্দেশ দিয়ে উঠে পড়ে। সকাল দশটার দিকে রিকসা ভাড়া মিটিয়ে সোজা ক্লাশ রূমের দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু সে দিকে যাওয়া হয়না তার। কেননা পশ্চিম কোণে কমনরূমের দিকে শিউলিকে দেখে সে দিকেই পা বাড়ায়। আসিফ কাছে আসা মাত্রই একটু মুচকি হেসে শিউলি জিজ্ঞেস করে, কেমন আছ আসিফ?
ভালো। খুব সংক্ষেপে উত্তর দেয় আসিফ।
-চল ঐ গাছটির নিচে গিয়ে বসি।
দুজনে এসে বড় বটগাছটির নিচে বসে পড়ে। নীরবতা ভঙ্গ করে শিউলি বলল, কি হয়েছে আসিফ, তোমাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন, কিছু হয়নি তো তোমার?
-আচ্ছা শিউলি, তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাস?
-হঠাৎ এ প্রশ্ন করছো যে?
-বল তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাস?
-পাখি যেমন নীল আকাশকে ভালোবাসে, নদী যেমন ভালোবাসার টানে সাগরের দিকে ছুটে যায়, আমি তার চাইতেও তোমাকে অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আসিফ।
-তোমার এ ভালোবাসা আমার জন্য চিরজীবন এমন থাকবে তো?
-হ্যাঁ, অবশ্যই থাকবে।
-আচ্ছা শিউলি চল এখন ওঠা যাক। আগামী কাল আমি তোমাদের বাড়ী আসছি, সেখানে সব কিছু খুলে বলব।
পরের রাত্রে আবারও অবাক হয়ে যায় আসিফ। সেই স্বপ্ন, হ্যাঁ সেই ভয়াবহ স্বপ্নটি আজও দেখেছে সে। শিউলিকে সব কিছু খুলে বলবে বলে তার বাড়ীর দিকে পা বাড়ায় আসিফ। শিউলি বাড়ীতে ছিল। আসিফ কে দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে বলল, বড্ড দেরী করলে যে, শরীর ভালো তো?
-খালা-খালু কই গেছেন?
-আব্বা অফিসে আর মা গেছেন ফুফুর বাড়ী বেড়াতে গেস্টরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল শিউলি।
-আচ্ছা শিউলি তুমি স্বপ্ন বিশ্বাস কর?
-স্বপ্নকে যে আমি পুরোপুরি অবিশ্বাস করি তা না আবার পুরোপুরি যে বিশ্বাস করি তাও কিন্তু না।
-তার মানে তুমি কিছু স্বপ্নকে বিশ্বাম করো।
-হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। তোমার কি হয়েছে আসিফ, তুমি দিন দিন কেমন যেন বদলে যাচ্ছ।
-শিউলি, আমি একটা ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছি, শুনবে তুমি সেই স্বপ্নের কথা।
-তোমার দুঃস্বপ্নের কথা শুনে এই মধুর পরিবেশটাকে এখন বিষাক্ত করে তুলতে চাই না, এখন তোমাকে দেখতে হবে সুখের স্বপ্ন আসিফ।
-আমার স্বপ্নের কথা তাহলে তুমি শুনবেই না?
-বললাম তো, দুঃস্বপ্নের কথা এখন শুনব না।
-ঠিক আছে, আমার স্বপ্নের কথা যখন তুমি শুনবে না, তাহলে তুমি থাক আমি চললাম। বলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে আসিফ। রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘোরাফিরা করে রাত্রটি ন’টার দিকে বাসে উঠে বসে সে। উদ্দেশ্য বন্ধু সোহেলের বাসা। ধা ধা করে বাস ছুটে চলছে। আর এদিকে আসিফ ভাবছে তার সেই দুঃস্বপ্নের কথা। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার কানে আসে তার। কিছুক্ষনের মধ্যেই মিলিয়ে যায় সব। সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাতে, পায়ে ও মাথায় রক্তমাখা অবস্থায় হাসপাতালের বেডে। সামান্য একটু চোখ খুলে দেখতে পায় মা, শিউলি আর খালা ও খালুকে। আসিফ শিউলিকে খুব কাছে ডেকে নিয়ে বলল, শিউলি তুমি তো আমার সেদিনের স্বপ্নের কথা শুনতে চাওনি। তবে আমার জীবণের এই শেষ লগ্নে শুনে যাও। আমি সেদিন কি দেখেছিলাম জান? আমি স্বপ্ন দেখছি আমি একটি বাসে চড়ে যাচ্ছি, ঠিক এরকমই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি, দুচোখে কিছুই দেখে যায় না। হঠাৎ একটা আর্ত চিৎকার ভেসে এল। তারপর স-অব চুপ। তারপর চোখের সামনে ভেসে এল কি জান? লাশ! আমারই নিজের রক্ত মাখা লাশ। যার পাশে বসে তুমি অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলছো আর হু হু করে কাঁদছো। আমার এই দুঃস্বপ্নটি সত্য হয়ে গেল তাই না শিউলি। এতটুকু বলেই আর কথা বলতে পারল না আসিফ। শিউলি আসিফের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে হু হু হু করে কাঁদতে লাগল।

0 মন্তব্যসমূহ