পাঁচ প্যাঁচাল

প্যাঁচাল-এক
স্কুল-কলেজে পড়াকালীন একটা কথা প্রায়ই শুনতাম যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তখন কথাটির মানে ঠিক বুঝতাম না। কারণ আমরা সকলেই জানি যার শুরু আছে তার শেষ আছে। রাজনীতির যা কিছুই হয় সেটা শুরু থেকেই আরাম্ভ হয়। কথাটার মানে বুঝতে পারলাম ভার্সিটিতে প্রবেশ করার পর এবং আরও পরিষ্কার হলো বর্তমানের কিছু ঘটনা দেখার পর।
আমরা বাংলার মানুষ সকলেই প্রায় যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। বর্তমান মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ওয়াদাও ছিল এটা। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ আদালতের একটা রায় নিয়ে দেশে এখন একটা তুলকালাম কান্ড ঘটে চলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে পনের দিন ধরে শাহবাগে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দেশের তরুন প্রজন্ম। তাদের একটাই দাবী সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ইতোমধ্যে ‍দুটি মামলার রায় হয়েছে। এর একটিতে আবুল কালাম আযাদের ফাঁসির রায় হয়েছে আর একটিতে আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। মূলত কাদের মোল্লার রায় ঘোষনার পরেই শুরু হয় শাহবাগের আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের দাবী সকল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে হবে। আর শাহবাগের সেই তরুন প্রজন্মকে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার এবং বাম দলীয় নেতা কর্মীরা। কিন্তু আমরা জানি এই আদালত গঠিত হয়েছে বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে এবং বিচারকরাও তাদের দ্বারাই নিয়োগ প্রাপ্ত। আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হয়। তারা বিচার-বিশ্লেষণ করেই তো রায় দিয়েছে। তারা তো আমাদের চেয়েও অনেক বেশি জ্ঞানি, অভিজ্ঞ। কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কি আদালতের রায় কে অসম্মান করা হচ্ছে না? আদালত অবমাননা হচ্ছে না? আবার অনেকেই বলছেন এটা সরকারের একটা রাজনৈতিক চাল। সরকার তার ব্যর্থতা গুলোকে ঢাকতেই আন্দোলনকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
প্যাঁচাল-দুই
মৃত্যু মাত্রই মানুষকে ভীত করে তোলে, ভাবায়। সমাজে কোন ভালো মানুষ মারা গেলে সকলেই সমবেদনা জানায়। কিন্তু কোন বির্তকিত মানুষ মারা গেলে কিছু মানুষ তার খারাপ দিকটা নিয়ে সমালোচনা করে আবার কিছু মানুষ তার গুণকীর্তনে মূখর হয়ে ওঠে। অর্থাৎ মৃত্যুর পরেও সে বির্তকিতই থেকে যায়।
রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যেমন সকলের রয়েছে সভা-সমাবেশ করার অধিকার, পছন্দ-অপছন্দের অধিকার তেমনি রয়েছে মানুষ হিসেবে সমাজে তার বেচেঁ থাকার অধিকার। কিন্তু এই আধুনিক সভ্য সমাজে যখন কিছু মানুষ মধ্যযুগীয় কায়দায় সাপমারার মতো করে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে তখন স্বভাবতই বিবেকবান মানুষকে ভাবায়, সেই মৃত্যুটা তাদের সব সময় পীড়া দিতে থাকে।
নাটোরের বড়াইগ্রামে তেমনি একটি মৃত্যূ দেখলাম আমরা। সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যানকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তথাকথিত ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা। যারা দাবী করে আমরা সভ্য জগতের মানুষ, দিন বদলের অঙ্গিকার নিয়ে আমরা ক্ষমতায় এসেছি কিন্তু তাদের দিন বদলের শুরুটা যে এভাবে শুরু হবে বাংলার আমজনতা সেটা আগে বুঝতে পারেনি বলে মনে হয়। উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূরুকে পিটিয়ে মারার দৃশ্যটি যেন আমাদের কে লগি-বৈঠার কথাই স্বরণ করে দেয়।
এই ঘটনার ক্ষত শুকাতেই না শুকাতেই নিজ বাসায় নৃশংস ভাবে খুন হলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। তারা খুন হওয়ার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই খুনিকে খুজে বের করা হবে বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। সেই আটচল্লিশ ঘন্টা আজও শেষ হয়নি।
বর্তমান সময়ের আর একটি আলোচিত হত্যাকান্ড হল বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড। নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগের কর্মীরা যেভাবে হত্যা করেছে সেটা কোন সভ্য জগতের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ নিহত হওয়ার পর এবার মারা গেল নিষ্পাপ শিশু রাব্বি। বিশ্বজিৎ শিশু রাব্বি নির্মম ভাবে নিহত হলেও আমরা দেখলাম না প্রধানমন্ত্রি তাদের বাসায় গিয়ে তাদের পরিবার কে স্বান্ত্বনা দিতে। সেখানে গিয়ে তিনি বললেন না যে, এই অপরাধের দায়িত্ব ছাত্রলীগের এবং এ জন্য ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হবে। যেমনটা তিনি বলেছিলেন থাবা বাবার (ব্লগার রাজীব) বাসায় গিয়ে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যদি বিশ্বজিতের বাসায় যেতেন তাহলে একটা ভারসাম্য রক্ষা হতো। কেউ এটা নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারতো না। আমিও ব্যক্তিগত ভাবে থাবা বাবার হত্যাকারীদের সর্ব্বোচ শাস্তি দাবী করি। কেননা আইনের উর্ধ্বে কেউ না। প্রতিটা নাগরিকের বেচেঁ থাকার অধিকার যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার। তবে এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে নিজের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গিয়ে অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসে যেন আঘাত না লাগে।
প্যাঁচাল-তিন
সেই ছোট বেলায় থেকেই আমরা শুনে আসছি ছোটদের কে স্নেহ করবে, বড়দের কে সম্মান করবে। আর সেটা যদি হয় শিক্ষাগুরু তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু গুরুজন কে সম্মান করার বিষয়টা এখন আর তেমন চোখে পড়েই না। তাই তো পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি শিক্ষাগুরুর প্রতি নির্মম আচরণ।
নিজ দলের পছন্দমতো কর্মীদের নিয়োগ না দেয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য
প্রাণ গোপাল দত্তের ওপর স্বাচিপ ও ছাত্রলীগের হামলা সে কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
এদিকে বরিশালে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের নতুন অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন শংকর চন্দ্র দত্ত।
গণমাধ্যমের কলাণে আমরা জেনেছি তাকে রিকসা থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হয়েছে, কিল-ঘুষি মারা হয়েছে। তাকে অপরাধীর মতো তাড়া করেছে ফিরেছে ছাত্রলীগের কর্মীরা। আবার এই ঘটনার পুরস্কার হিসেবে আমরা দেখি সেই অধ্যক্ষকেই আবার ওএসডি করে রাখা হয়েছে। তার অপরাধ তিনি সঠিক সময়ে কলেজে যেতে পারেননি। কি বিচিত্র এ দেশ! জীবনের প্রথম স্কুলের পাঠ আমরা যে শিক্ষকের কাছ থেকে নিই সেই শিক্ষকরাই দাবী আদায় করতে গেলে বিষাক্ত পেপার স্প্রে মারা হয় তাদের ওপর।
প্যাঁচাল-চার
শাহবাগের তরুন প্রজন্মের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে প্রথমদিকে আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছিলাম সেখানে। আমি সেখানে গিয়ে চিৎকার করে বলেছি সকল রাজাকারের ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই আমার মনে হল আন্দোলনটা আর একমূখী থাকছে না। আজ শাহবাগে যারা প্রতিদিন যারা জড়ো হচ্ছে তাদের মূল দাবী কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের ফাসির দাবী ইসলামী ব্যাংক কিংবা কোন গণমাধ্যম বন্ধের দাবি না। একত্তুরের যে সকল চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আছে সে যে মতের, যে দলেরই হোক না কেন আমরা তার উপযুক্ত বিচার চাই। কিন্তু কিছুদিন থেকে প্রজন্ম চত্তর হতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম আর ধর্মের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। আমার মনে হয় তরুন প্রজন্মের আন্দোলনটি তার লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হচ্ছে। এভাবে অনেক দাবী একসাথে করলে একটা লেজে-গোবরে অবস্থার সৃষ্টি হবে। আর তাই ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনকে ঘিরে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে।
প্যাঁচাল-পাঁচ
এই আন্দোলনের ফলে মহাজোট সরকারের একটু হলেও উপকারই হয়েছে বলা যায়। কেননা তরুন প্রজন্মের এই আন্দোলনের ফলে সরকারের গত চার বছরের ব্যর্থতা একটু হলেও আড়ালে চলে গেছে। শেয়ার বাজার কেলেংকারী, কুইক রেন্টাল, পদ্মা সেতু, রেলওয়ে, হলমার্ক, ডেসটিনি,সাগর-রুনি হত্যা, বিশ্বজিৎ হত্যা, শিশু রাব্বি হত্যা, নিয়োগ বাণিজ্য, বিরোধীদলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন প্রভৃতিতে ভাটা পড়েছে।
শেষ প্যাঁচাল
বর্তমান পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের সমালোচনা করলেই বলা হয় যে সে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে। সে রাজাকার। যেমনটা আমরা দেখেছি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর বেলায়। তিনি সরকারের সমালোচনা করেছিলেন বলেই আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে তাকে রাজাকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

0 মন্তব্যসমূহ