লাল-সবুজের পতাকা

রাতের অন্ধকার এখনো কাটেনি। রাস্তা ছেড়ে সরু আলপথ ধরে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে মেয়েটি। আকাশ ফর্সা হওয়ার আগেই তাকে পৌঁছতে হবে হায়েনার চোখ ফাঁকি দিয়ে। জায়গাটি বেশ নির্জন। এমন নির্জনতাকে সঙ্গি করেই প্রায় প্রতিদিনই এই কাজটি তাকে করতে হয়। সেই রাত দ্বিপ্রহরে ঘুম থেকে উঠে চুলায় রান্না বসিয়ে সবজি কাটতে বসে যায়। আজানের অনেক আগেই রান্না শেষ করে বড় সাইজের একটা গামলায় খাবারগুলো নিয়ে মাথায় করে দৌড়ায়। মেয়ে মানুষ। কিন্তু ভয়-ডর বলে কিছু নেই তার। তিন কূলে যার কেউ নেই তার আবার ভয় কিসের। কয়েক মাস আগেই বাবা মারা যায়  পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে। মাও তার অপমান সইতে না পেরে আত্মহুতি দিয়েছেন। পালিয়ে গিয়েছিল বলেই রক্ষা পেয়েছিল জমেলা। বাপের মতোই সাহসী হয়েছে মেয়েটি। চোখে-মুখে তার সব সময় ঘৃনার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আর সে আগুনে কল্পনায় প্রতিদিন জ্বলে মারে হায়েনাদের। শুধু বাবার হত্যা আর মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই নয় দেশ থেকে লোভী শকুনীদের তাড়ানোর জন্যই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ না নিলেও সে পরোক্ষভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই সে খাবার নিয়ে হাজির হয় দেশ মাতৃকার তরুণ সন্তানদের আস্তানায়।

আজ একটু দেরীই হয়েছে তার। কেননা গত সন্ধ্যা রাতে কুখ্যাত হালিম মোল্লা গিয়েছিল তার বাড়িতে। রাজাকার খ্যাতি আছে তার। কোন রকমের ভণিতা না করেই একেবারে জমেলার দরজার সামনে গিয়ে বলল, ‘কিরে  জমেলা প্রতিদিন কই যাস তুই, সারাদিন তোর দেহা পাওন যায় না। কোন কাম-টাম করছোস নাকি?’ বলেই শকুনী দৃষ্টিতে সে জমেলার দিকে চায়। জমেলা তখন সবে মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা থেকে ফিরে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল। সে মোল্লার চোখের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘কই আর যামু, কাম করন লাগবো না? কামের খোঁজে গেছিলাম।’
-ভাল কইরা কাজ-কাম করিস, তয় উল্টা-পাল্টা কিছু করিস না জানি আবার? তহন কিন্তু আমি আর তোরে আগলায়ে রাখতে পারুম না।
-কে কইছে আমারে আগলায়ে রাখতে?
-এতো চ্যাতোছ ক্যারে? আমি ছাড়া তোর কি কেউ আছে? বলেই আর একবার জমেলার শরীরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে যায়। জমেলা রাগে ফোঁপাতে থাকে সাপের মতো। সে যদি পুরুষ হইতো তবে এখনই হয় তো এই দেশদ্রোহীকে মেরে ফেলতো। তারপরেও মনে মনে হাতে রাখা ঝাড়ু দিয়ে মোল্লার মুখে ঝাড়ু পেটা করে। মেয়েদের এই হয়েছে এক জ্বালা। এরা মুখ ফুটে সত্য কথাটিও বলতে পারে না। সত্য বললেই সমাজ গেল গেল বলে রব উঠায় হালিম মোল্লারা।

খাবারের গামলাটা মাথা থেকে নামিয়েই একটা লম্বা শ্বাস নেয় জমেলা। দ্রুত এসেছে বলে হাঁপিয়ে উঠেছে।
-জমেলা আপু আজ বুঝি তোর খুব কষ্ট হয়েছে। গামলার ঢাকনাটি খুলতে খুলতে বলে রশীদ।
-হ, শালার মোল্লা মনে হয় আমাক সন্দেহ করে। কাল আমার বাড়ি আইসা বেশ কিছু জিগাইল।
-মোল্লা মানে ঐ শালার রাজাকার হালিম মোল্লা না? শালারে যদি একবার নাগাল পাই তাইলে বন্দুকের তিনডা গুলি ওর বুকের ভিতরে হান্দাই দিমু। বেশ তেজ নিয়ে পাশ থেকে কথাগুলো বলে আজমত। আজমত ছেলেটি বেশ চটপটে। তারা পিঠাপিটি দুই ভাই এসেছে দেশের জন্য যু্দ্ধ করতে। আজমত আর রহমত। এক বছরের ছোট-বড়। তাদের মা’ই তাদেরকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েছে। আসার সময় রহমত আমতা আমতা করছিল দেখে মা বলেছিল, এমন করছিস ক্যান বাবা? তোরা তো এক মা কে রেখে আর এক মাকে বাঁচাতে যাচ্ছিস আর সেই মা হচ্ছে সাত কোটি বাঙ্গালীর মা। সেই মায়ের সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্যই তোদের দুই ভাইকেই আমি না হয় কুরবানী দিলাম। মাকে আর বেশি কিছু বলতে হয় নি তখনই তারা মুক্তিকামী মানুষের কাতারে নাম লিখিয়েছে।

ওরা বেশ কয়েকজন একসাথে থাকে। জায়গাটি একদম সীমান্ত ঘেষা, নিরাপদ ‍ও সুন্দর । অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখানে আসতে হয়। বলা চলে জমেলার সাথে এ দলটির পরিচয় কিছুটা হঠাৎ করেই। তার বাবাকে যখন পাক হায়েনারা গুলি করে মেরে লাশ ফেলে রেখে চলে যায় সেই লাশ দাফন করার মতো কেউ ছিল না গাঁয়ে। অধিকাংশ মানুষই পালিয়ে গিয়েছিল। আর যারা ছিল তারাও হালিম মোল্লার ভয়ে এগিয়ে আসেনি। একদিকে মা হারানোর শোক অন্যদিকে সামনে বাবার লাশ দুটো শোকেই একদম পাথর হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি। ঠিক সেই সময়ে পিছনে কিছু লোকের পায়চারীর ধীর শব্দ শুনতে পেল জমেলা। সাহসী মেয়ে হয়েও তখন অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল সে। গগন বিদারী একটা চিৎকার দিবে এমন সময় একটা কণ্ঠ তার কানে এসে বাজে।
-চুপ করো আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তোমার বাবাকে দাফন করতে এসেছি। মাথাটি পিছনে ঘুরেই জমেলা দেখতে পায় কাফনের কাপড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন যুবক। সেই অন্ধকার রাতেই তারা লাশ দাফন করে চলে যায়। এটা কে ঠিক চলে যাওয়া বলে না। তারা আশ্রয় নেয় গ্রামের অদূরেই একটা নির্জন জায়গায়। যার নাম বিন্নি বাড়ির ভিটা।

জমেলা প্রায় সারাটি দিন তাঁদের সাথেই থাকে। বিভিন্ন অপারেশনের গল্প শোনে, এসব গল্প শুনে শুনে তারও এমন বীর হতে ইচ্ছে জাগে। কিন্তু বীর হতে না পারলেও তার আজ কোন আফসোস নেই। কেননা সে বীরদেই সহযোগী হয়েছে, তাদের রসদ যোগান দেয়, মানসিক শক্তি যোগায়, ভাই বলে সম্বোধন করে যুদ্ধ করতে উৎসাহ দেয়। এই তো গতকালই তারা সদর থানায় হামলা করেছিল। তখন তাদের দুই সহযোগী শহীদ হয়।
জয়ের মুখ দেখতে আর খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আজমত বলেছে খুব বেশি হলে দিন দুয়ের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে। তারা তাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে হায়েনাদের বিতাড়িত করতে পারবে। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকা হায়েনা মুক্ত হয়েছে। যুদ্ধ জয়ের কথা শুনে বিজয়ের হাসি খেলে যায় জমেলার ঠোঁটে। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয় না। দেখে সামনে দাঁড়িয়ে মোল্লা।
-কই গেছিলি পাপী মেয়ে? মোল্লা চোখ গরম করে প্রশ্ন করে।
-কই আবার যামু, কামের খোঁজে গেছিলাম।
-মিথ্যা কস আমার লগে। জানোস মিথ্যা বলা মহা পাপ। আজ তোর মুখ দিয়ে সত্য বের করে ছাড়ুম। বলেই হুংকার দিয়ে ওঠে মোল্লা। আর কিছু মনে করতে পারে না জমেলা।

যখন জ্ঞান ফেরে দেখে তখন দেখে তার চারদিকে ধ্বংসস্তুপ। সেই স্তুপের মধ্যেই বিজয়ের পতাকা পতপত করে উড়ছে। লাল-সবুজের একটি পতাকা দিয়ে তার দেহ ঢাকা পাশেই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে আজমত।

0 মন্তব্যসমূহ