রোশনীর জীবন

অবশেষে অনেক ভেবে-চিন্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছায় রোশনী। সিদ্ধান্তটি সে নিয়েছে আজ ভোরের দিকে। তখন সবে মধ্যরাতের আঁধার কেটে গেছে। জানালা খুলে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেয় মেয়েটি। দেখে বেশকিছু বাসার বারান্দার লাইটগুলো তখন জ্বলজ্বল করে জ্বলে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে অন্ধকার পৃথিবীকে। তার বুকের ভিতরটাও জ্বলতে কিন্তু পার্থক্য এটুকুই যে লাইটের আলো সবাই দেখতে পারলেও তার বুকের ভিতরটা যে পুড়ে কালো ছাই হয়ে গেছে তা কেউ দেখতে পারছে না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার পর সে আর বিছানায় ঘুমাতে পারেনি। শুধু ভেবেছে এমন সিদ্ধান্তের শেষ পরিণতি কি হতে পারে? কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে তার পরিবারে। তার মায়ের চোখে অশ্রু আসবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না রোশনী। কেননা সৎে মায়েরা আর যাই হোক সতীনের সন্তানের জন্য এমন কামনা হয়তো করেই থাকেন। আর কাঁদলেও হয়তো মায়া কান্না করবেন প্রতিবেশীদের দেখানোর জন্য। তার বাবা হয়তো পাগলের মতো হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন হয়তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাবেন। তার একমাত্র ছোট ভাইটির জন্য এখন প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এছাড়া কিবা করার আছে তার। ছোট ভাইয়ের কথা মনে হতেই টপ করে দু’ফোটা চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রোশনীর। পাশেই তার ছোট ভাই রুদ্র ঘুমিয়ে। মা মারা যাওয়ার পর রোশনীর সাথেই থাকে সে। ফর্সা চেহারার রুদ্রকে আজ আরও সুন্দর লাগছে যেন। আস্তে করে জানালাটি আবার বন্ধ করে দিয়ে রুদ্রর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে শুয়ে পড়ে রোশনী।

রোশনী। ২৫ বছরের টগবগে এক যুবতী মেয়ের নাম। কিন্তু রোশনী নামের অর্থ আলো হলেও সে নিজেকে আলোকিত করতে পারেনি। অভাবের সংসারে টানাটানির কারণে এসএসসি পরীক্ষাটাও দেয়া হয়নি তার আগেই বউ সাজতে হয়েছে তাকে। উপরন্তু চেহারাতেও রোশনীর অভাব রয়েছে তার। শুধু দেখতে সুন্দর নয় বলেই পাত্র পক্ষের দাবী ছিল অনেক। বাবাও মেয়ের সুখের জন্য তাদের দাবী অনুযায়ী সবকিছু দিবে বলে স্বীকার করে নিলেও পরবর্তীতে সব দাবী পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আর সম্ভব হয়নি বলেই রোশনীর স্থান এখন নিজের বাপের বাড়ীতে। বিচ্ছেদের প্রায় এক বছর হল তার। এই এক বছরের মধ্যে বেশ কয়েকবার তাকে আবারো বিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। কতবার যে সেজেগুঁজে বরপক্ষের সামনে হাজির হয়েছিল সে নিজেই জানে না। কিন্তু তার আর বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। কখনো যৌতুকের কারণে, কখনও বা তার চেহারার কারণে বিয়ে হবে হবে করেও আর শেষ পর্যন্ত হয়নি।
আজ আবারও তার সেজে থাকার পালা। আজই বিকেলে পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে। মূলত সে জন্যই তার আজকে এমন কঠিন পণ। সে আজকের পর থেকে কোনদিন আর অন্যের কাছে উপস্থাপিত হতে চায় না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে আর বেশি দেরী নেই। ইতোমধ্যে সংবাদ এসেছে পাত্রপক্ষ কনেকে দেখার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। সংবাদ শুনে তৈরি হতে থাকে রোশনী। এতো আশংকার মধ্যে থেকেও আজকে কেন জানি তার মনের মধ্যে একটু ভাল লাগাও কাজ করতে থাকে। বুকের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হয়।

বাড়ির আঙিনায় রাখা বেশ কিছু খালি চেয়ার রাখা এখন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সেজে থাকা রোশনীকে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে। তাকে বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। লোকগুলোর মধ্যে থাকা বয়স্ক ব্যক্তিটি তো এক সময় বলেই বসল যে, ‘মা একটু হেঁটে দেখাও তো’?
শুনে গা জ্বলে ওঠে রোশনীর। ‘এই বুড়া কি এতোক্ষন দেখেনি যে আমি হেঁটেই এখানে এসেছি’ হাটতে গিয়ে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলে সে। কনে দেখার পর্ব শেষ। রোশনী বসে আছে তার রুমে। রুমটির চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তার দৃষ্টি এসে বদ্ধ হয়ে থাকে তার বাঁ পাশেই রাখা ছোট্ট বোতলটির দিকে। আবার উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে তার বাবার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে বেশ জোরের সঙ্গে কথা বলছে সেই বুড়ো লোকটি। কোন এক অজানা আশংকায় বুকটা রোশনীর দেহটা কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণ পরেই তার সৎ মায়ের কণ্ঠ কানে আসে। কণ্ঠ শুনেই সবকিছু বুঝে যায় সে। আবারও তার সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। আর এদিকে রোশনীর বয়স, তার দেহের সৌন্দর্য নিয়ে তার সৎ মা একের পর এক গালি দিয়েই চলেছেন।

রুমের দরজা আগেই আটকানোই ছিল। এবার খোলা জানালাটা আস্তে করে আটকে দেয় রোশনী। বাঁ পাশে রাখা বোতলটি হাতে নিয়ে কর্কটি খুলে ভিতরে রাখা সবটুকু তরল এক নিঃশ্বাসে চালান করে দেয় পেটের ভেতর। রোশনীর মাথা ঘুরতে থাকে। অনেক লাল-নীল আলোর খেলা দেখতে পায় সে। যে আলোর খেলাগুলো এক সময় সে বুকে লালন করত। ধীরে ধীরে বিছানায় এলিয়ে পড়ে রোশনী।

0 মন্তব্যসমূহ