জিহ্বার লাগাম টেনে ধরুন

আমরা বাঙ্গালী। সারা বিশ্বে বাঙ্গালীদের একটি বিশেষ পরিচয় আছে সেটি হচ্ছে- আমরা কাজের চেয়ে কথা বলি বেশি। আমরা যারা সাধারন আমজনতা তাদেরকে একটু বেশি কথা বলতেই হয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমরা কথা বলি, অন্যের সমালোচনা করি অফিস-আদালতে, হাটে-বাজারে, পাড়া-মহল্লায়, বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় এবং পরিবারে। দেশের রাজনীতিবিদরা কথা-বার্তা বলেন, বিভিন্ন সভায় তারা বক্তব্য-বিবৃতি প্রদান করেন। পার্থক্য এটুকুই যে বাংলার আমজনতার কথা-বার্তা একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে আর রাজনীতিবিদদের কথা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আমজনতা তাদের কথা-বার্তা নিয়ে সমালোচনা করে, হাসি-মস্করা ঠাট্টা করে অনেকেই বা ছিঃ ছিঃ করে নাক ছিটকায়। রাজনীতিবিদদের তেমনি কিছু কথা-বার্তা নিয়েই আমার আজকের এই রচনা।
প্রথমেই আসি আমাদের শ্রদ্ধেয় অর্থ মন্ত্রি আবুল মাল আব্দুল মুহিদের কথায়। আমাদের দেশের বরেণ্য ব্যক্তি ড. ইউনুস সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল এরকম-
* ‘ড. ইউনুস দেশের একমাত্র সমস্যা…, ড. ইউনুসের কথায় সততা নেই’।
* ‘গ্রামীন ব্যাংক সরকার দখল করে নিয়েছে বলে ড. ইউনুস যে মন্তব্য করেছেন তা টোটালি রাবিশ’।
আমরা এখন প্রায়ই সকলেই জানি বর্তমান মন্ত্রিসভার মন্ত্রিরা একটু কথা বেশিই বলেন। হলমার্ক কেলেংকারিতে সরকারের ইমেজ যখন সংকটের মুখে তখন মাননীয় অর্থ মন্ত্রি বললেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা তেমন বেশি কোন টাকা নয়।’ কিন্তু মন্ত্রি সাব হয় তো জানেন না, দেশের একজন দিন মজুরের কাছে এই দুর্মূল্যের দিনে দশ টাকা দশ লক্ষ টাকার মতো মূল্যবান। তাই তাকে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, চার হাজার কোটি টাকা যদি তেমন বেশি কিছু না হয় তাহলে কত হাজার কোটি টাকা তার কাছে মূল্যবান। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে যখন সবাই পথে বসতে শুরু করেছে তখন তিনি মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো মন্তব্য করলেন ‘যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে তারা ফটকাবাজ’।
তার আরও কিছু অমৃত বচন হল-‘একদিন বাজারে না গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’, ‘বাসা বাড়ীতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা উচিৎ’, সাভারের ঘটনা কিছুই না’।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও কথায় কম যান না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি শুধু নিজ দলের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি দেশের ষোল কোটি মানুষের প্রধানমন্ত্রি। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রীও প্রায় প্রতিদিনই মন্ত্রিদের মতো বাক যুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন। যার কোনটি ইতিমধ্যেই সমালোচিত হয়েছে, মানুষকে আহত করেছে কিংবা আমজনতার মাঝে হাস্য-রসের উদ্রেক করেছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিজ রুমে খুন হওয়ার পর যখন সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বইছে তখন তিনি বললেন ‘সবার বেড রুম পাহারা দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ তার আরও কিছু বক্তব্য হচ্ছে ‘আমার চেয়ে বড় দেশ প্রেমিক আর কে আছে’?, ‘আমি হয়তো আছি তাই বাংলাদেশ নিরাপদে আছে’, ‘আমার চোখ বন্ধ হলে কী হবে তা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন জানেন’, ‘আমার বেয়াই রাজাকার হলেও যুদ্ধাপরাধী নয়’, ‘আমার আমলে উৎপাদিত তিন হাজার পাঁচশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বন্ধ করে শিক্ষা দেব’,‘এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করলাম তা যেন চোখেই পড়ে না’, ‘আমাদের যথেষ্ট টাকা থাকলে ডিসিসি চার ভাগে ভাগ করতাম’।
বর্তমানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু মিডিয়ার স্বাধীনতা যে মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে একথা সকলেই জানে। সর্বশেষ রাতের আধারে দুটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়াটাই তার একটি প্রমাণ। কিন্তু তার পরেও প্রধানমন্ত্রি বলেন, ‘আমরা সরকারে আসার পর মিডিয়া সম্পুর্ন স্বাধীনতা পাচ্ছে, প্রতিদিন সরকারের বিরুদ্ধে না লিখলে তাদের ভাত হজম হয় না’।
মহাজোট সরকারের মন্ত্রিরা কখন কি বলেন তা তারা নিজেরাই জানেন না। জনতার বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হওয়া সরকারে অযোগ্যরাই মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। তাই তারা অতি আনন্দে হয়তো কথার খেই হারিয়ে ফেলেন। মন্ত্রি ফারুক খানের একটি উক্তি বেশ কিছু দিন ধরে ‘টক অব দি টাউনে’ পরিণত হয়েছিল। সেটি হল তার কম খাওয়ার তত্ত্ব। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা কম খান, তাহলে তো জিনিস পত্রের দাম বাড়বে না’।
তারা আরও একটি মন্তব্য হল ‘পেয়াজ না খেলে কি হয়।’ জনাব ফারুক খান হয়তো পেয়াজের উপকারীতার কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
আমরা জানি জিয়া বীরত্বের সাথে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু মতিয়া চৌধুরী হয়তো সেটি জানে কি না সেটা আল্লাহই জানেন। তাই তিনি বলেন, ‘জিয়া মুক্তিযুদ্ধ করলেও মন থেকে করেননি’।
আমরা জানি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান অনেক আগেই উঠে গিয়েছে। রাজনীতিবিদরা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধারোধ রেখে কথা বলতে পারেন না। তাই দেখা যায় মতিয়া চৌধুরী খালেদা জিয়া উদ্দেশ্য করে বলেন ‘সারাদিন মেকাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে দিন বদল দেখবে কেমন করে..।’ মন্ত্রি শাহজাহান খান টকশো বচনে চোখ তুলে নেয়া আর জুতো পেটা করার মন্তব্যটিও দেশের মানুষকে মারাত্মাক ভাবে আহত করেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি সাহারা খাতুনের মন্তব্য নিয়েও একসময় দেশে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। তার মন্তব্যগুলো হল- ‘পুলিশ আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে’, ‘আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে’, স্বাধীনতার চল্লিশ বছরের মধ্যে বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা সবচেয়ে ভালো আছে’।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) নির্মমভাবে কিশোরী ফেলানী কে হত্যা করে কাটাতারের বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখে। যেটা নিয়ে সারা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ফেলানী বাংলাদেশী হওয়ার পরেও তার উক্তি ‘ফেলানী ভারতের নাগরিক, তারপরেও বাংলাদেশ তার জন্য অনেক কিছু করেছে’।
‘যারা বাসা-বাড়ী বা দোকান বন্ধ রেখে ঢাকার বাইরে যাবেন, তাদের ঠিক মতো তালা বন্ধ করে যেতে হবে’, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি হিসেবে তার এসব উক্তি দেশের মানুষ ভালোভাবে গ্রহন করেনি।
বর্তমান মন্ত্রি সভার সদস্যদের আরও কিছু অমৃত বচনঃ
প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুঃ ‘পুলিশ থেকে সাংবাদিক দূরে থাকুন’, ‘বঙ্গবন্ধু জন্মের সাথে সাথেই না কেঁদে জয় বাংলা বলে উঠেছেন’, ‘আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকলেই কেবল দেশে শান্তি আসে’, ‘ এখন কৃষককে আর সার খুঁজতে হয় না, সার-ই কৃষককে খুঁজে’।
কুইক রেন্টাল নিয়ে উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহির মন্তব্য ‘ কুইক রেন্টাল নিয়ে যারা কথা বলবে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী’।
ড্রাইভিং লাইন্সেস নিয়ে মন্ত্রি শাহজাহান খানের মন্তব্য ‘চালকরা গরু-ছাগল চিনলেই হবে’, ‘প্রধানমন্ত্রীর অভিজ্ঞ ড্রাইভারও ক্লাশ ফাইভ পাশ’, ‘এনকাউন্টারে সন্ত্রাসী মরলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না’।
মন্ত্রিরা বিভিন্ন সময়ে এরকম শত শত মন্তব্য করেছেন। তাদের এসব অমৃত বচন লিখতে গেলে আরও কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা যাবে। কিন্তু যুগটা যেহেতু ডিজিটাল যুগ তাই মন্ত্রিদের এসব কথা-বার্তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে ফেসবুক, ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে। কিন্তু যাদের নিয়ে এই লেখা সেই মন্ত্রিদের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা কাজের চেয়ে কথাই বলে যাচ্ছেন বেশি। এদিকে বিরোধী দলও কথায় কম যান না।
কথায় কথা বাড়ে। তাই আমিও আর বেশি কথা লিখতে চাই না। লেখাটি শেষ করবো সরকারের কিছু ইসলাম বিরোধী কথা দিয়ে।
আমরা জানি ক্ষমতায় আসার আগে সরকার ওয়াদা করেছিল তারা নির্বাচিত হলে ইসলাম বিরোধী কোন আইন করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তার উল্টো। সরকারের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড ও মন্তব্য দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দেয়া, ধর্ম নিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন, আল্লাহ ও রাসূল (সা.) কে নিয়ে কটুক্তি এবং দাড়ি-টুপি বোরখাধারীদের হয়রানি।
গত এগারোর অক্টোবরে দুর্গাপুজোয় এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘এবার গজে চড়ে মা দুর্গা আসায় ফসল ভালো হয়েছে’।
সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী বলেছিলেন, ‘সংবিধান থেকে ধর্মের কালো ছায়াটুকু মুছে ফেলা হবে’।
পাট মন্ত্রি বলেছিলেন ‘ধর্ম তামাক ও মদের মতো একটি নেশা’।
ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান বলেছিলেন, রাসুল (সা.) মসজিদের অর্ধেক জায়গা হিন্দুদের ছেড়ে দিয়েছিলেন’।
মন্ত্রিদের এহেন কথা-বার্তায় জনগন তাদের ওপর ধীরে ধীরে আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। বাংলাদেশে শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান এবং তারা প্রায়ই সকলেই ধর্মভীরু। বাংলার এসব ধর্মভীরু লোকজন এবং আলেম সমাজ ইতিমধ্যেই সরকারকে ইসলাম বিরোধী ভাবতে শুরু করেছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে আলেম-ওলামারা অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তাই মন্ত্রিদের উচিৎ হবে জিহ্বার লাগাম টেনে ধরা। নয় তো আগামী নির্বাচনে তারা ধরা খেয়ে যাবেন জনগনের কাছে।

0 মন্তব্যসমূহ